গুরু, আচার্য, পুরোহিত, পন্ডিত ও পূজারির মধ্যে পার্থক্য জানুন।

 প্রায়শই লোকেরা পুরোহিতকে পণ্ডিতজি বা পুরোহিতকে আচার্য বলে ডাকে এমনকি শ্রোতাও তাদের সঠিক জ্ঞান দিতে সক্ষম হয় না। এগুলি বিশেষ পদের নাম যার সঙ্গে কোনো বিশেষ বর্ণের কোনো সম্পর্ক নেই। আসুন জেনে নিই উপরের কথার প্রকৃত অর্থ কি তাই এখন থেকে আমরা কোন পুরোহিতকে পন্ডিত না বলি।



গুরু: গু মানে অন্ধকার আর রু মানে আলো। তার মানে যিনি আপনাকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যান তিনি হলেন গুরু। গুরু মানে অন্ধকার ধ্বংসকারী। যারা আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান বা ধর্মীয় বিষয়ে উপদেশ দেন তাদের এবং গুরুর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। গুরু আত্ম বিকাশ এবং ঈশ্বর সম্পর্কে কথা বলেন। প্রত্যেক গুরুই একজন সাধু; কিন্তু প্রত্যেক সাধকের গুরু হওয়া জরুরী নয়। মাত্র কয়েকজন সাধুরই গুরু হওয়ার যোগ্যতা আছে। গুরু মানে ব্রহ্ম জ্ঞানের পথপ্রদর্শক।


আচার্য: আচার্য হলেন সেই ব্যক্তি যিনি বেদ ও শাস্ত্রের জ্ঞান রাখেন এবং যিনি গুরুকুলে ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য কাজ করেন। আচার্য শব্দের অর্থ হল সেই ব্যক্তি যিনি আচার-আচরণ, নিয়ম- নীতি ইত্যাদিতে পারদর্শী এবং অন্যকে শিক্ষা দেন। যিনি আচার-অনুষ্ঠানে পারদর্শী এবং যজ্ঞ ইত্যাদিতে প্রধান পুরোহিতের ভূমিকা পালন করেন তাকেও আচার্য বলা হত। বর্তমানে আচার্য একটি কলেজের প্রধান কর্মকর্তা ও শিক্ষক।


পুরোহিত: পুরোহিত দুটি শব্দ নিয়ে গঠিত: 'পার'এবং 'হিট', অর্থাৎ এমন ব্যক্তি যিনি অন্যের কল্যাণের জন্য চিন্তা করেন। প্রাচীনকালে যে আশ্রমে শিক্ষা দেওয়া হত সেই আশ্রমের প্রধানকে বলা হত পুরোহিত। তবে, যজ্ঞ সম্পাদনকারী প্রধান ব্যক্তিকেও পুরোহিত বলা হত। এই পুরোহিতকে সব ধরনের আচার-অনুষ্ঠানের জন্যও নিযুক্ত করা হয়। প্রাচীনকালে, পুরোহিতরাও কিছু রাজপরিবারের সাথে সম্পর্কিত ছিল। অর্থাৎ, রাজদরবারে পুরোহিতদের নিযুক্ত করা হয়েছিল, যারা ধর্মীয় কাজকর্ম দেখাশোনার পাশাপাশি উপদেষ্টা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।



পুরোহিতঃ পূজা ও আবৃত্তি সম্পর্কিত এই শব্দের অর্থ স্বতঃসিদ্ধ। অর্থাৎ, যিনি মন্দিরে বা অন্য কোনও স্থানে পুজো করেন তিনিই পুরোহিত। যে ব্যক্তি দেবতার মূর্তি বা মূর্তির পূজা করে তাকে পুরোহিত বলা হয়।


পণ্ডিত: পাণ্ডা মানে বৃত্তি। কোনো বিশেষ জ্ঞানে পারদর্শী হওয়াকে পাণ্ডিত্য বলে। পন্ডিত মানে কোন বিশেষ জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ বা দক্ষ। তাকে পণ্ডিত বা বিশেষজ্ঞও বলা যেতে পারে। যে বিশেষ জ্ঞানের জ্ঞান আছে কেবল তিনিই পণ্ডিত। প্রাচীন ভারতে বেদ ও ধর্মগ্রন্থের অগাধ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিকে পণ্ডিত বলা হত। এই পণ্ডিতকে পাণ্ডে, পাণ্ডে, পাণ্ড্য বলা হয়। বর্তমানে এই নামটি ব্রাহ্মণদের উপাধিতে পরিণত হয়েছে। কাশ্মীরের ব্রাহ্মণরা কাশ্মীরি পণ্ডিত নামে পরিচিত। স্থানীয় ভাষায় পণ্ডিতের স্ত্রীকে পণ্ডিতেন বলার রীতি আছে।


ব্রাহ্মণ: ব্রাহ্ম শব্দটি ব্রাহ্ম থেকে এসেছে। যিনি ব্রহ্মা (ঈশ্বর) ব্যতীত অন্য কারো উপাসনা করেন না তাকে ব্রাহ্মণ বলা হয়। যে পৌরোহিত্য করে জীবিকা নির্বাহ করে সে ব্রাহ্মণ নয়, ভিক্ষুক। যিনি জ্যোতিষী বা নক্ষত্রজ্ঞানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি ব্রাহ্মণ নন, জ্যোতিষী। পণ্ডিত একটি বিষয়ের বিশেষজ্ঞ এবং যিনি গল্পটি বর্ণনা করেন তিনি ব্রাহ্মণ নন, গল্পকার। এভাবে যে বেদ ও ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু করে সে ব্রাহ্মণ নয়। যার মুখে ব্রহ্ম শব্দ উচ্চারণ করে না সে ব্রাহ্মণ নয়।



স্মৃতি পুরাণে ৪ প্রকারের ব্রাহ্মণের বর্ণনা আছে- মাত্র, ব্রাহ্মণ, শ্রোত্রিয়, অনুচন, ভ্রূণ, ঋষিকল্প, ঋষি ও মুনি। শ্রুতিতে পূর্বে ৮ প্রকার ব্রাহ্মণের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া বংশ, জ্ঞান ও নৈতিকতায় উন্নীত ব্রাহ্মণদের বলা হয় 'ত্রিশুক্ল'। ব্রাহ্মণকে ধর্মীয় বিপ্র ও দ্বিজও বলা হয় যাদের কোনো জাতি বা সমাজের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।

Post a Comment

0 Comments